নিজস্ব প্রতিবেদক
জনতার বাণী,
ঢাকা: অভিযোগ আছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার
কারণে বিএনপি চেয়ারপারসনের সাথে সাক্ষাৎ
করতে পারেন না তৃণমূলের নেতারা। এবার নেত্রীকে
সামনে পেতেই মুখোশ খুলে দিলেন পদপদবি নিয়ে
বসে থাকা সুবিধাবাদী কেন্দ্রীয় নেতাদের।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও দলের
শীর্ষ নেতাদের সামনেই কেন্দ্রীয় নেতাদের নানা
অনিয়ম ও ব্যর্থতার কথা বলার সুযোগ পেয়ে সময়ের সৎ
ব্যবহার করেছেন দলটির তৃণমূলের নেতারা।
এসময় সমোচ্চারিত কণ্ঠে তারা আন্দোলের সময়
বেইমানি করা এবং মোবাইল ফোন বন্ধ রাখা
নেতাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে দলের
চেয়ারপারসনের প্রতি আহ্বান জানান।
ষষ্ঠ কাউন্সিলের মাধ্যমে গঠিত নতুন কমিটিতে
পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতাদের স্থান দেয়ার দাবিও
জানিয়েছেন বিএনপির তৃণমূলের নেতারা।
শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স
ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয়
কাউন্সিলের দ্বিতীয় পর্বে দলের সাংগঠনিক
প্রতিবেদনের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে এই আহ্বান
জানান জেলা ও উপজেলা থেকে আসা
কাউন্সিলররা।
এর আগে বিকেল ৫টায় আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় পর্ব
শুরু হয়। প্রথমে দলের ও দেশের এবং আন্তর্জাতিক
ক্ষেত্রে প্রয়াত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মৃত্যুতে শোক
প্রস্তাব আনা হয়। এরপর সাংগঠনিক প্রতিবেদন তুলে
ধরেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল
ইসলাম আলমগীর।
প্রথম বক্তা হিসেবে বক্তব্য দিতে গিয়ে দলের
স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক ও নাটোর জেলার সভাপতি
রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু খালেদা জিয়ার উদ্দেশে
বলেন, ‘ম্যাডাম, যারা বিগত দিনে বেইমানি
করেছে, আপনি নির্দেশ দিলে ১৫ দিনের মধ্যে
সরকার পতন ঘটাবে বলে আশ্বাস দিয়ে মোবাইল
ফোন বন্ধ করে রেখেছিল, তাদের চিহ্নিত করতে
হবে। আপনার নির্দেশে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা
রাজপথে নেমে এসেছিল।’
দুলু বলেন, ‘আপনি টিম লিডার। কারা নতুন টিমে
থাকলে, কাদের হাতে নেতৃত্ব দিলে আওয়ামী
লীগের পতন হবে, তা ভেবেচিন্তে দায়িত্ব দেবেন।
প্রয়োজনে সময় নেবেন। তবে আমাদের দাবি, নতুন
কমিটি নিয়ে কেউ যাতে ব্যবসা করার সুযোগ না
পায়।’
বরিশাল জেলা (উত্তর) সাধারণ সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর
রহমান বলেন, ‘আমরা শুধু মহাসচিব চাই না। এমন
একজন অভিভাবক হবেন, যিনি ডাক দিলে ইউনিয়ন
থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী রাজপথে
নেমে আসে।’
কুদ্দুসুর রহমান বলেন, ‘নেতাদের আমলনামা হিসাবে
নিতে হবে। এক-এগারোর সময় এবং গত আন্দোলনের
ভূমিকা আমলনামা হিসেবে দেখতে হবে। বেইমান,
মীরজাফরকে নতুন কমিটিতে দেখতে চাই না।
তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বেইমানি করেনি। যদি
বেইমানদের চিনতে চান তাহলে আশপাশ আর পেছনে
তাকালে দেখতে পারবেন।’ কোনো সিনিয়র নেতা
যদি ব্যক্তিগত স্বার্থে কমিটিতে কারো নাম দেয়,
তা না রাখতে খালেদার প্রতি অনুরোধ জানান
তিনি।
নরসিংদী জেলার সভাপতি খায়রুল কবির খোকন
বলেন, ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসির কর্মসূচিতে
রাজধানীতে নেতাকর্মীরা রাজপথে ছিলেন না।
অনেক নেতা মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছিলেন।
তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী ঢাকায় এসে নেতাদের
পায়নি। ওই দিন রাজপথে নামলে সরকারের পতন
হতো।’
তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করার দাবি
জানিয়ে খোকন বলেন, ‘ঢাকা থেকে কমিটি চাপিয়ে
দিলে হবে না। পকেট কমিটি করা যাবে না।
কাউন্সিলের মাধ্যমে তৃণমূলে সম্মেলনের ব্যবস্থা
করতে হবে।’
মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ি থানা বিএনপির সভাপতি
খান মনিরুল মনি নির্বাহী কমিটিতে
মুখোশধারীদের চিহ্নিত করার দাবি জানান। তিনি
বলেন, ‘কেন ২০১৪ সালের আন্দোলন বন্ধ করা হয়েছিল,
তা আমরা জানতে চাই।’
এই নেতার দাবি, ‘দলে তিন শ্রেণির নেতা রয়েছেন।
এক গ্রুপ আছেন যারা টিভিতে ছবি ওঠানোর জন্য
ব্যস্ত থাকেন। অন্য গ্রুপে আছেন মুখোশধারীরা।
তারা বড় বড় পদ নিয়ে বসে আছেন। ফোন করলে
তাদের পাওয়া যায় না। এমনকি বাসাও পাল্টে
ফেলেন যাতে না পাওয়া যায়।’
তিনি বলেন, ‘এক মাস ধরে দেখতেছি মিছেমিছি
আন্দোলনের ফাইল নিয়ে নয়াপল্টন ও গুলশান অফিসে
যাচ্ছে একটি পক্ষ। তারা বড় বড় পদ চায়। তাদের
দিকে খেয়াল রাখতে হবে।’
আন্দোলনে ব্যর্থতার কারণগুলো সাংগঠনিক
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা উচিত ছিল বলে মন্তব্য
করেন কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার সভাপতি
অ্যাডভোকেট গোলাম মোহাম্মদ। জাতীয়
নির্বাহী কমিটির আকার কমানোর দাবি জানিয়ে
তিনি বলেন, ‘অনেক বড় কমিটি, কিন্তু কাজের নাম
লবডঙ্কা।’
ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তৈমুর
রহমান আগামী কাউন্সিল তিন দিন ধরে করার দাবি
জানান। তিনিও ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর
আন্দোলন বন্ধ করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
তিনি জেলা ও উপজেলার সভাপতি, সাধারণ
সম্পাদকের পাশাপাশি সাংগঠনিক সম্পাদক এবং
এক নম্বর যুগ্ম সম্পাদক, এক নম্বর ভাইস চেয়ারম্যানকে
কাউন্সিলর করার দাবি জানান। ভারপ্রাপ্ত
মহাসচিবকে ভারমুক্ত করার দাবি করেন তিনি।
৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পরের আন্দোলন বন্ধ করার
কারণ জানতে চান নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি
উপজেলার সভাপতি আনোয়ারুল হক কামাল।
খালেদা জিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে রাঙামাটি সদর
উপজেলা বিএনপির সভাপতি মামুনুর রশিদ মামুন
বলেন, ‘বিগত দিনে ওয়ানডে খেলেছি। আপনি
খেলোয়াড় নির্বাচন করেছিলেন। আমরা ওয়ানডে,
টেস্ট খেলেছি। মাসের পর মাস অবরোধ করেছি,
কিন্তু জিততে পারিনি। আমরা জানতে চাই আপনার
খেলোয়াড়রা কি ম্যাচ ফিক্সিং করেছিল?’ তিনি
বলেন, ‘আমরা এখন টি-টোয়েন্টি খেলতে চাই। এই
খেলার খেলোয়াড় আপনি নির্বাচন করবেন।’
সাবেক এমপি বিলকিস জাহান শিরিন কারো
অনুরোধে জাতীয় নির্বাহী কমিটির কোনো পদ না
দেয়ার আহ্বান জানান। খালেদা জিয়ার উদ্দেশে
তিনি বলেন, ‘বরিশালসহ সারা দেশের চিত্র আপনি
চোখ বন্ধ করলে দেখতে পারবেন- কারা আন্দোলনে
ছিল। ইতিহাস বলে, আপনি একা যেসব সিদ্ধান্ত
নিয়েছেন তা কার্যকর হয়েছে।’
শিরিন বলেন, ‘নারী হিসেবে নয়, কর্মী হিসেবে
আমাদের দেখুন। আমরা কেন বিএনপিতে পদ পাবো
না। অথচ কিছু নেতা আছেন যারা ১০ থেকে ২০ বছর
পর্যন্ত এক এলাকা দখলে রেখেছেন অনেকটা
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো। এটা চলতে পারে না।’
গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলা সভাপতি হুমায়ুন
কবির খান বলেন, ‘আন্দোলনের সময় কিছু কিছু নেতা
বড় বড় কথা বলতেন। সেসব নেতার পাসপোর্ট দেখা
দরকার। এদের কেউ আবার ভারত ঘুরে এসে বলেছেন
তারেক সাহেবের সঙ্গে দেখা করে এসেছি। এতে
নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত করা হয়।’
নিজ জেলায় ১৭ বছর ধরে ছাত্রদলের কমিটি নেই
দাবি করে হুমায়ুন বলেন, ‘কিন্তু আমার জানামতে
অনেক নেতা কয়েক বিঘা জমি বিক্রি করে
নেতাদের টাকা দিয়েছে। কিন্তু নেতা হতে
পারেনি। কমিটি করার ক্ষেত্রে বাণিজ্য বন্ধ করতে
না পারলে দলের জন্য ভালো হবে না।’
দীর্ঘদিনে নির্বাহী কমিটির সভা না হওয়ায় ক্ষোভ
প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘নেতাদের পরামর্শ যদি না
নেন তাহলে নির্বাহী কমিটি নয়, লিমিটেড কমিটি
করে দেন।’
হেফাজতের সমাবেশের দিন নেতাকর্মীদের
ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানালেও কাউকে পাওয়া
যায়নি বলেও দাবি করেন তিনি।
নওগাঁ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোবাইল বন্ধ রাখা
নেতাদের চিহ্নিত করার দাবি জানান। খালেদা
জিয়ার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘উপঢৌকন, আম ও
চালের বস্তার বিনিময়ে এবার যেন কমিটি না হয়।’
বিএনপির ইতিহাসে মহাসচিব পদে কোনোদিন
প্রার্থী হয়নি, এবারও নেই- এমন দাবি করে সময়
নিয়ে মহাসচিব পদসহ নির্বাহী কমিটির নেতৃত্ব
নির্বাচনের প্রস্তাব করেন যুবদল সভাপতি সৈয়দ
মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল।
জয়পুরহাট জেলার সভাপতি মোজাহার আলী প্রধান
বলেন, ‘দলে দালাল বের হয়েছে। ফেসবুকে মিথ্যা
তথ্য দিয়ে এসব দালাল নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত
করছে।’
এ ছাড়া বেশ কয়েকজন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের
নেতা সাংগঠনিক প্রতিবেদনের ওপর বক্তব্য দেন।
নেতারা হলরুমে যখন এই বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখন হলের
ভেতরে ও বাইরে থাকা নেতাকর্মীদের দেখা গেছে
হাততালি দিয়ে তাতে সমর্থন জানাতে।