নিউজ ডেস্ক
জনতার বাণী,
ঢাকা: সিলেটে শিশু
সামিউল আলম রাজনকে
নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার
ঘটনায় দেশের মানুষ স্তম্ভিত।
সাধারণ মানুষ বিচারের
দাবিতে মাঠে নেমেছেন।
আর অপরাধ বিজ্ঞানীরা
বলছেন বিচারহীনতা এবং
অসুস্থ সমাজের পরিণতি হল এই
নির্মমতা।
গত বুধবার সকালে সিলেটের
জালালাবাদ এলাকায় চোর
সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা
হয় ১৩ বছরের রাজনকে।
নির্যাতনকারীরা শিশুটিকে
পেটানোর ২৮ মিনিটের
ভিডিও ধারণ করে
ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়।
সেই ভিডিও দেখে
সামাজিক যোগাযোগ
মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
মূলধারার সংবাদমাধ্যমও
তাদের অনলাইন সংস্করণে
প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড়
বয়ে যাচ্ছে। আর দাবি
উঠেছে অপরাধীদের
গ্রেপ্তারের।
সিলেট সদর উপজেলার
কান্দিগাঁও ইউনিয়নের
বাদেআলী গ্রামের
মাইক্রোবাস চালক শেখ
আজিজুর রহমানের ছেলে
রাজন স্থানীয় অনন্তপুর
সরকারি প্রাথমিক
বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি
পর্যন্ত পড়ালেখা করে।
পরিবারকে সাহায্য করতে
সে ভ্যানে করে সবজি
বিক্রি করত।
ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে বলা
হয়েছে, ‘মস্তিষ্কে আঘাতের
কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণই
রাজনের মৃত্যুর কারণ। তার
শরীরে ৬৪টি আঘাতের চিহ্ন
রয়েছে।’
সিলেটের জালালাবাদ
থানা পুলিশ এরইমধ্যে
হত্যাকাণ্ডে জড়িত একজনকে
গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে
নিয়েছে। আরেকজনকে
সন্দেহজনক হিসেবে
গ্রেপ্তার করা হয়েছে।মূল
সন্দেহভাজন সৌদি আরবের
জেদ্দায় গ্রেপ্তার হয়েছে।
ভিডিও ফুটেজ দেখে মোট
চারজনকে চিহ্নিত করা
হয়েছে, বাকিরা পলাতক।
মন্ত্রী ও পুলিশের বক্তব্য
জালালাবাদ থানার
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আক্তার
হোসেন জানান, ‘পুলিশ
নিজেই বাদি হয়ে একটি
হত্যা মামলা দায়ের করেছে৷
মামলায় নির্যাতনকারী
মুহিত, তার ভাই কামরুল ইসলাম,
তাদের সহযোগী আলী
হায়দার ওরফে আলী ও
চৌকিদার ময়না মিয়া ওরফে
বড় ময়নাকে আসামি করা
হয়েছে।
এদের মধ্যে মুহিত ও কামরুলকে
গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
ওসি জানান, ‘এই ঘটনায়
কোনো আসামিই রেহাই
পাবে না৷ সবাইকে আইনের
আওতায় আনা হবে।’
এদিকে সোমবার ঢাকায়
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী
আসাদুজ্জামান কামালও
বলেছেন, ‘ঘটনাটি হৃদয়বিদারক
ও মর্মস্পর্শী। একজনকে
রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
আরও একজনকে গ্রেপ্তার করা
হয়েছে। বাকিদেরও দ্রুত
গ্রেপ্তার করা হবে। কাউকে
ছাড় দেওয়া হবে না।’
বিক্ষোভ
এদিকে সোমবার মুহিতকে
রিমান্ডের জন্য আদালতে
নেয়ার পথে সাধারণ মানুষ
ব্যাপক বিক্ষোভ এবং ঘৃণা
প্রকাশ করেন। তারাঁ
অপরাধীদের ফাঁসি চেয়ে
স্লোগান দেন। সিলেটের
সাংবাদিক জানান, ‘এই
ঘটনায় সিলেটবাসী স্তম্ভিত
এবং ব্যথিত। তারা বিচার
চেয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে
মাঠে নেমেছেন।
সামাজিক যোগাযোগ
মাধ্যমে এই নির্মম
নির্যাতনের ভিডিও ফুটেজ
ছড়িয়ে পড়ার পর তা
ইউটিউবেও আপলোড করা হয়।
তবে ইউটিউব কর্তৃপক্ষ তাদের
নীতিমালার কারণে
রোববার বিকেলে
ভিডিওটি তাদের ওয়েবসাইট
থেকে সরিয়ে নেয়। তবে
ফেসবুকসহ আরো অনেক
সামাজিক যোগাযোগ
মাধ্যমে ভিডিওটি এখনো
আছে।
অপরাধ বিজ্ঞানীর
প্রতিক্রিয়া
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক
হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন,
‘সমাজে বিচারহীনতা এবং
অসুস্থ মানসিকতার প্রকাশ এই
নির্মম শিশু নির্যাতন।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি
শেকড় গেঁড়ে বসায় একটি
শিশুকে নির্মম নির্যাতন করে
হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ
করতে তারা সাহস
পেয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘যারা এই কাজ
করেছে তারা ভয়ংকর বিকৃত
মানসিকতার। তবে তাদের এই
কাজের মধ্য দিয়ে আমাদের
অসুস্থ সমাজের চেহারা
বেরিয়ে এসেছে। শিশুদের
প্রতি সমাজ যে দরদি নয় তারই
প্রকাশ ঘটেছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের
দেশের আইনে ৯ বছর পর্যন্ত
শিশুরা কোনো অপরাধ করে
বলে গণ্য করা হয় না। আর ১৮ বছর
পর্যন্ত শিশুরা অপরাধ করে না,
ভুল করে। কিন্তু আইনের এই কথা
হৃদয়ে নেই। ফলে এই নির্মমতা
ঘটেছে।’
মানবাধিকার কর্মীর দৃষ্টিতে
মানবাধিকার নেত্রী
অ্যাডভোকেট এলিনা খান
বলেন, ‘এই বর্বরতা সীমাহীন৷
শিশুর প্রতি সহিংসতার জন্য
আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাই
দায়ী।
তিনি বলেন, ‘শিশুটিকে
বুধবার প্রকাশ্যে পিটিয়ে
হত্যা করা হয় অনেক লোকের
সামনে। আর তা ভিডিওতে
ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু সেই
ভিডিও সামাজিক
যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে
পড়ার পর প্রতিবাদের ঝড়
উঠলে চারদিন পর রোববার
পুলিশ তৎপর হয়। আমার প্রশ্ন,
প্রকাশ্যে ঘটা এই নির্মমতার
খবর কী তখন পুলিশের কাছে
পৌঁছায়নি? নিশ্চয়ই
পৌঁছেছে। তাহলে পুলিশ
কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেন?’
এলিনা খান বলেন, ‘আমাদের
সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার
ভেতরেই নারী ও শিশুর প্রতি
সহিংসতার বীজ লুকানো
রয়েছে।’ তিনি বলেন,
‘নির্যাতনকারীরাই
নির্যাতনের ভিডিও করেছে।
এটা প্রমাণ করে এই দেশে
অপরাধীরা কতটা বেপরোয়া।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের মত
এদিকে শুধুমাত্র নির্মমভাবে
শিশু নির্যাতনের এই ঘটনাই নয়,
এর আগে দুই নারীকে গাছের
সঙ্গে বেঁধে নির্মম
নির্যাতনের ছবিও সামাজিক
যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ
হয়েছে। আর সামাজিক
যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্য ও
ছবি ধরেই মূলধারার
সংবাদমাধ্যম ছবি ও খবর
প্রকাশ করে।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন
আহমেদ সাবির বলেন, ‘এর দুটো
দিক আছে। একটা হলো
অপরাধীরাই এসব ছবি এবং
ভিডিও সামাজিক
যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়ে
তাদের ক্ষমতা দেখাতে চায়।
আবার সাধারণ মানুষই এসব
অপরাধের ছবি তুলে
বিচারের আশায় তা
সামাজিক যোগাযোগ
মাধ্যমে দেয়। মোবাইল ফোন
এবং ইন্টারনেটের প্রসার
এটাকে সহজ করেছে৷ তবে এই
ফুটেজ ও ছবি প্রকাশে কোনো
নীতিমালা মানতে চান না
সামাজিক মাধ্যম
ব্যবহারকারীরা।’
তিনি বলেন, ‘তবে ইতিবাচক
দিক হলো মানুষ আর মূলধারার
সংবাদ মাধ্যমের অপেক্ষা
করছে না। তারা
তাৎক্ষণিকভাবেই সামাজিক
যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেই
সম্প্রচার কর্মী হয়ে উঠছে।
ফলে এখন আর অনেক অপরাধের
ঘটনাই চাপা রাখা যায় না।’
সূত্র: ডয়চে ভেলে
