আন্তর্জাতিক ডেস্ক
জনতার বাণী,
ঢাকা: ‘ওদের যাওয়ার সময়
আমরা কেউ কোনো কথা
বলিনি। চারপাশে
অনিশ্চয়তা। একটা শব্দও উচ্চারণ
করতে পারিনি, শুধু ছোট
ছেলেটাকে একবার শক্ত করে
জড়িয়ে ধরেছিলাম।’
২০ বছর আগে বসনিয়ার যুদ্ধের
সময় দুই ছেলে আর স্বামীর
নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে চলে
যাওয়ার মুহূর্তটির কথা
বলছিলেন ফাতিমা আরজিক
(৬৬)।
দুই দশক পার হয়ে গেলেও আজও
ওই ছেলের স্পর্শ অনুভব করেন
ফাতিমা। পরে অবশ্য
ছেলেকে আবার দেখেছেন
তিনি। চোখের পানি আটকে
রেখে জানালেন সে কথাও,
‘আমি ওকে দেখেছি। একটা
পায়ের পাতা, একটা হাত,
একটা পা…। বড় যন্ত্রণার
দেখা।’
এই ছেলেকে খুঁজে পাওয়া
যায় ৯৩ জনের এক গণকবর
থেকে। মারা যাওয়ার সময় ওর
বয়স হয়েছিল ১৭। আগামী ১১
জুলাই স্রেব্রেনিচার
স্মৃতিকেন্দ্রে তাকে পুনরায়
কবর দেওয়া হবে। তার সঙ্গে
আরো ১৩৫টি দেহাবশেষও
সেখানে শেষ ঠাঁই নেবে।
এদের মধ্যে ফাতিমার স্বামী
এবং ২১ বছর বয়সী মেজো
ছেলেও রয়েছেন।
বসনিয়ায় ফাতিমার মতো মা
বা স্ত্রী এখনো অসংখ্য।
রেঝা ও সাবাহেতা তাদের
অন্যতম। ২০ বছরে তারা মধ্যবয়স
থেকে প্রৌঢ়ত্বে পা
দিয়েছেন। অথচ এখনো
তাদের মনে হয়, ওই ভয়াবহ
ঘটনা ঘটেছে গতকালই।
বসনিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় মুসলিম
ছিটমহল স্রেব্রেনিচায়
খ্রিস্টান সার্বরা হামলা
চালায় ১৯৯৫ সালের ১১
জুলাই। সে সময় ছিটমহলটি
জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণে
ছিল। ফাতিমা ওই দিনের
কথা মনে করে বলেন, ‘সব
জায়গায় বোমা পড়ছিল।
রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে
ছিল হতাহতদের শরীর। বহু মানুষ,
নারী-শিশুরা দৌড়ে
পালাচ্ছে। এ সময় পুরুষ ও ছেলে
শিশুরা আলাদা হয়ে
পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
আমরা ওদের থেকে আলাদা
হয়ে গেলাম।’
ফাতিমার স্বামী ও দুই
ছেলেও ওই দলের সঙ্গে রওনা
দেন। অন্তত ১৫ হাজার মুসলিম
পুরুষ ও ছেলে শিশু মুসলিম
বাহিনী নিয়ন্ত্রিত ৬০ মাইল
দূরের এক এলাকায় যাওয়ার
চেষ্টা চালায়। কয়েক হাজার
লোক পৌঁছেও যায়। তবে সবাই
পারেনি।
ফাতিমা আর তার মা
স্রেব্রেনিচার বাইরে
পোতোকারিতে
জাতিসংঘের ঘাঁটিতে
গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানে
আরো প্রায় ২৬ হাজার মানুষ
ছিল, যাদের বেশির ভাগই
নারী ও শিশু। কয়েক শ পুরুষও
তাদের সঙ্গে ছিল।
পঁচানব্বইয়ের ওই জুলাই মাসের
কয়েক দিনে সার্বরা ওই
আশ্রয়কেন্দ্রে অন্তত আট
হাজার মুসলিম পুরুষ ও শিশুকে
হত্যা করে। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের পর এটাই ছিল
ইউরোপের সবচেয়ে ভয়াবহ
গণহত্যার ঘটনা।
এখন পর্যন্ত ৬,২০০ নিহতের
পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব
হয়েছে। তাদের
পোতোকারিতে গড়ে
তোলা স্মৃতিকেন্দ্রে
সমাহিত করা হয়েছে।
রেঝা আদেমোভিচ দিনের
একটা বড় সময় পার করেন তার দুই
ছেলের হাস্যোজ্জ্বল ছবি
দেখে। ওই গণহত্যার মাত্র তিন
মাস আগে ছবিটি তোলা হয়।
তার বড় ছেলের নাম নাজির
(২২), ছোটটির নাম মুয়ামের
(১৫)। বাবার সঙ্গে ওই দুই
ছেলেও ওই দিন ওই মিছিলে
যোগ দেয়।
‘আমি ভেবেছিলাম বয়স কম
বলে ছোটটা হয়তো বেঁচে
যাবে। কিন্তু ওর লাশই প্রথমে
পাওয়া যায়।’ নাজিরের লাশ
পাওয়া যায়নি। ২০০৬ সালে
মুয়ামেরের লাশ
স্মৃতিকেন্দ্রে সমাহিত করা
হয়েছে। ওদের বাবাকে
ওখানে সমাহিত করা হবে
শনিবার (১১ জুলাই)।
‘আমার মন থেকে ওরা কখনো
সরে না। প্রায়ই রাতে ঘুম হয়
না। খুব ভালো ছেলে ছিল
ওরা। এত কম বয়সে চলে গেল-
এটাই দুঃখ।’
বয়সের কারণে ছাড় পায়নি
সাবাহেতা ফেজিকের
ছেলে রিজাদও (১৬)। এই
কিশোর তার মায়ের সঙ্গে
জাতিসংঘের ঘাঁটিতে
আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে
সার্বরা ওকে নিয়ে যায়।
‘ওরা আমার ছেলেকে ডান
দিকে যেতে বলেছিল। কিন্তু
আমরা একসঙ্গে ছিলাম। এরপর
ওরা ওকে হাত ধরে টেনে
নিয়ে যায়। আমি কিছু করতে
পারিনি। রিজাদ কাঁদতে শুরু
করে আমাকে শুধু বলেছিল, মা,
তুমি চলে যাও।’
দিনটি সাবাহেতাকে
এখনো তাড়া করে ফেরে।
সূত্র: এএফপি
